১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

এই শহরের সকলের প্রিয় মুখ “স্বপন সেন” দাদা মিটুল দাশ গুপ্ত

বাংলা বারুদ
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৩, ২০২৫, ০৫:২৮ অপরাহ্ণ
এই শহরের সকলের প্রিয় মুখ “স্বপন সেন” দাদা মিটুল দাশ গুপ্ত

Manual8 Ad Code

চট্টগ্রাম : আমাদের চট্টগ্রাম শহরের সেই ঈশ্বর নন্দী লেইন থেকে শুরু করে আন্দরকিল্লা, চেরাগি হয়ে জামালখান ও নিউ মার্কেটের দোস্ত বিল্ডিং এর আশে পাশে ছোট বড় সকলের প্রিয় মুখ হয়ে ওঠা আমাদের গণমানুষের রাজনীতিক স্বপন সেন, শহরের ব্যাস্ত রাস্তার পাশ ধরে রোজ সকাল সন্ধ্যা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলা মানুষটিকে আমাদের চট্টগ্রামের রাজনৈতিক উইকিপিডিয়া বলে উল্লেখ করতাম। সর্বশেষ গত ৬ অক্টোবর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে উনার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা সৌরিন্দ্র নাথ সেন জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করান, খবরটা পাওয়া মাত্র ছুটে গেলাম, স্বপন সেন দাদা হাসপাতালের আইসিইউ এর বেডে শুয়ে আছে, আমি যাওয়ার পর আমাকে দেখে তিনি হঠাৎ জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন, তখন আমিও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ি, স্বপন দার অসুস্থতা নিয়ে আমি ফেইসবুকে একটা পোস্ট করি, আমার পোষ্ট টা একটু ক্ষোভ ও আক্ষেপের ছিল, হাসপাতেলে ভর্তির পর দেখতে আসেন আমাদের প্রিয় অধ্যাপক অশোক দা, এর পরদিন অশোক দা সহ সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি কমরেড শাহ আলম ভাই ও অমিতাভ দা, এর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে জানলাম সংগঠক হায়দার আলী চৌধুরী ভাই সাথে অজিত শীল ও রানা সহ তাঁকে দেখতে এসেছেন। এর পরদিন আমার ফোনে একটা কল আসে, কলটি ছিল আমাদের এক সময়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা অবিভক্ত ন্যাপের সাবেক নেতা ও বিএনপির প্রয়াত বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান ভাইয়ের ছেলে ইস্ট ডেলটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ আল নোমান আংকেলের, তিনি আমাকে ফোন করে স্বপন দাকে দেখতে আসার কথা বলেন এবং রাত ১০.২০মিনিটে জেনারেল হাসপাতালে হাজির হন, প্রথমে স্বপন দা কিছুক্ষণ থাকিয়ে থাকলেন, এরপর ২ জনের মধ্যে সেই যেন দীর্ঘ দিন পর পুনঃসাক্ষাতের পর পারিবারিক নস্টালজিয়ায় একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরলেন, পুরো হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, সকলে তখন অন্যরকম দৃশ্য অনুভব করল, সেদিন এই সজ্জন, অমায়িক, মানবিক তরুণ রাজনীতিক সাঈদ আল নোমানের উপস্থিতিতে ডাক্তার, নার্স, বয় সকলকে আবিভ‚ত করেছিল। তিনি বললেন ইনি আমার কাকা, সেই ছোট বেলা থেকে যার আদর, স্নেহ পেয়েছি এবং বাবার থেকে উনার দল ন্যাপের ইতিহাসও এই দলটির মানুষগুলোর সততা আর দেশপ্রেমের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা শুনে আমার বড় হয়ে ওঠা, সব মিলিয়ে আমার কাকা স্বপন সেন কে দেখতে ব্যাকুল হয়ে উঠি, উনার কথাগুলো আমাকে আবেগ আপ্লুত করে তুলেছিল। শুরু করেছিলাম সকলের প্রিয় মুখ স্বপন দাদার কথা দিয়ে, একটু ফিরে যেতে চাই আমার সেই ‘৮০ দশকের শৈশবের ছাত্র রাজনীতিতে, ৮২ থেকে ৮৬ সালে উত্তাল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন স্বপন দা ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির পাঠ চুকে আমাদের মহানগর ন্যাপের রাজনীতির সাথে যুক্ত, ‘৯০দশকের শেষদিকে ১৯৮৭/৮৮ সালের আন্দোলনে স্বপন দার কদর বেশি ছিল, বিশেষ করে সভা সমাবেশে ইতিহাস নির্ভর বক্তৃতা দিয়ে মানুষদের উজ্জীবিত করার জন্য। সবশেষে নিউজ নিয়ে পত্রিকা অফিসে ছুটে যাওয়ার জন্য ডাক পড়ত স্বপন দাদার। আজো মনে পড়ে সেই ‘৮৮ আন্দোলনে চট্টগ্রামের লালদীঘিতে ৮দলীয় জোটের বিক্ষোভ মিছিলে তৎকালীন স্বৈরশাসকের পেটোয়া বাহিনী খুনি রকিবুল হুদার নির্দেশে গুলি বর্ষণ ও লাঠির আঘাতে সেইদিন এই মানুষটির দিগি¦দিক ছুটে চলা। একটুর জন্য তৎকালীন ৮দলীয় জোটের প্রধান নেত্রী সহ কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের অসংখ্য নেতা কর্মী প্রাণে রক্ষা পেলেও আমরা হারিয়ে ফেলি ২৪ জন নাম নাজানা আরো অনেককে। এরপরে তরুণ ছাত্র জনতা তথা ছাত্র ঐক্যের যুগপৎ অটল সিদ্ধান্তে ৩ জোটের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, ‘৯০এর ডিসেম্বরের ৪ তারিখ ঘোষণা হলেও ৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়, এই বিজয়ে আজো মনে পড়ে স্বপন দার ভূমিকা। ২০০৪ সালের শেষ দিকে আন্দোলন সংগ্রামকে আরো বেগবান করতে আওয়ামীলীগ, ১১দল, জাসদ ও ন্যাপ (মোজাফফর) এর নেতৃত্বে একটি জোট গড়ে তোলা হয়, পরে এই জোট ১৪ দলীয় জোট হিসাবে পরিগণিত হয়। এই জোট গঠনে চট্টগ্রামে ১৪ দলের রাজনীতির প্রধান সমন্বয়ক বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ চট্টগ্রামের জাতি, ধর্ম-বর্ণ দলমত নির্বিশেষে আপামর সকল শ্রেণী পেশার গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা চট্টল বীর প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে জোটের কর্মসূচীতে আমিও সারাক্ষণ যুক্ত থাকতাম। সভা সমাবেশে অন্যান্য নেতাদের সাথে এই শান্ত, ধীর, রাজনীতিক মানুষটি গত বেশ কবছর আগে গণতন্ত্রী পার্টিতে যোগ দিলেও সকলে ন্যাপের স্বপন সেন বলত, সেই স্বপন দা আমৃত্যু আন্দোলন সংগ্রামে নিবিড় ভাবে যুক্ত হতেন। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, গত ১লা বৈশাখ ১৪এপ্রিল ২০২৫ ইং শ্রদ্ধেয় সুভাষ দে দাদা ও আমরা ন্যাপ ও ছাত্র সমিতির নেতা কর্মীরা মিলে উনার ঈশ্বর নন্দী লেইনের বাসায় দেখতে গিয়েছিলাম, সেদিনও সকলের উপস্থিতিতে উনার রাজনৈতিক ইতিহাস বলে যাওয়া আজো আমাদের সকলের হৃদয়ে নাড়া দেয়। একদিন আন্দরকিল্লায় তাঁর সাথে দেখা, তিনি আমাকে কিছু খাওয়াতে বললেন, আমি তাঁকে কিছু নাস্তা করাই, এর পর তিনি হাটলেন, আমি তাঁকে অনুসরণ করি। উনি চকবাজারের টেম্পোতে উঠলেন, আমিও সাথে উঠলাম, জিজ্ঞেস করলাম কৈ যাবা দাদা, উত্তর দিল না, চকবাজার এসে উনি নেমে চট্টগ্রাম মেডিকেলের দিকে হাটছে, আমিও উনাকে অনুসরণ করে একটু দূরে পিছন পিছন হাটতে শুরু করলাম, এক সময় দেখি উনি রুগী কল্যাণ সমিতিতে গিয়ে উনার বিভিন্ন পকেটে থাকা খুচরো টাকাগুলো দিচ্ছেন, মোট ৩২৭৫ টাকা দিলেন, অনুরুপ ভাবে চট্টগ্রাম কদম মোবারক এতিমখানা থেকে শুরু করে নানা জায়গায় টাকা দিতেন, এই টাকা গুলো ঘর থেকে উনাকে হাত খরচের জন্য দেয়া হতো। সেই টাকাগুলোই মূলত নিজের জন্য খরচ না করে এসব প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দিতেন। আজ কেন জানি মনে হয় স্বপনদা যথাযথ চিকিৎসা ও পুষ্টিগত সেবা ও পরিচর্যা পেলে হয়তো আরো বেশিদিন এই মানুষটাকে আমাদের মাঝে পেতাম। উল্লেখ করতে হয় ৪ ভাই ১বোনের মধ্যে ছোট স্বপন দা। উনার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা সৌরিন্দ্র নাথ সেন উভয়ে চির কুমার, উনার বাবা শহীদ হৃদয় রঞ্জন সেন ছিলেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, এছাড়া উনি বৃটিশ বিরোধী স্বরাজি আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালিন সেপ্টেম্বর কি অক্টোবরের দিকে উনাকে পাক বাহিনী তুলে নিয়ে যায়, গত ৯অক্টোবর ভোর ৪.১৫মিঃ অধ্যাপক অশোক দাদার ফোন পেলাম স্বপন দা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুর খবর ফেসবুকে দিলে দেশ বিদেশের অগনিত মানুষ শোক জানায়, এতে বুঝা যায় তিনি কত জনপ্রিয় ছিলেন। মহান সৃষ্টি কর্তার নিকট তাঁর আত্মার শান্তি কামনা এবং উনার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই, “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”

Manual8 Ad Code

 

লেখক :
রাজনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক
ও পরিবেশ সংগঠক

Manual3 Ad Code