বিশেষ প্রতিনিধি
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বিস্তৃত কক্সবাজারকে আমরা চিনি বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত হিসেবে। প্রায় ১২০ কিলোমিটার জুড়ে থাকা এই বালুকাবেলা, বঙ্গোপসাগরের বিশাল ঢেউ আর অসীম দিগন্ত শুধু পর্যটকের নয়, বরং সাহিত্যিক, শিল্পী, কবি, গীতিকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্যও এক অন্তহীন অনুপ্রেরণার উৎস। কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জেলে সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা এবং স্থানীয় লোকসংস্কৃতি সাহিত্য ও শিল্পের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে বহুভাবে।
কবিতায় সমুদ্রের প্রতিফলন:
বাংলা কবিতায় সমুদ্র সবসময়ই এক অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস। কক্সবাজারের সমুদ্র কেবল প্রকৃতির এক বিরাট বিস্ময় নয়, এটি কবিদের কল্পনা ও আবেগেরও শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছে। কবিরা এখানে খুঁজে পান সীমাহীনতা, স্বাধীনতার স্বপ্ন, জীবনের অনন্ত জটিলতা এবং ভালোবাসার অনির্বাণ প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অনেক কবিতায় সমুদ্রকে শক্তি ও মুক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যদিও তিনি সরাসরি কক্সবাজার নিয়ে কবিতা লেখেননি, তবু সমুদ্রের উচ্ছ্বাসকে তিনি বিদ্রোহ ও মুক্তির সঙ্গে মিলিয়েছেন। অন্যদিকে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সমুদ্র হয়ে উঠেছে একাকিত্ব ও অস্তিত্বের প্রশ্নের প্রতীক।
কক্সবাজারের সমুদ্র বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে আধুনিক কবিদের লেখায়। কবি আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় সমুদ্রের তরঙ্গ, জেলেদের জীবন ও উপকূলীয় বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। আবার শামসুর রাহমানের কবিতায় সমুদ্র এসেছে প্রেম, বিচ্ছেদ ও মানব জীবনের চিরন্তন আবেগের প্রতীক হয়ে। এছাড়াও সমসাময়িক কবিরা কক্সবাজার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, যেখানে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, ঝাউবন, আকাশের নীলিমা ও মানুষের ভিড়ের মধ্যেও এক অদ্ভুত একাকিত্ব ফুটে উঠেছে। বিশেষত সৈকতের ঢেউ কবিদের কাছে এক চিরন্তন সঙ্গীতের মতো, যা কল্পনা ও অনুভূতির দরজা খুলে দেয়। বলা যায়, সমুদ্র এবং বিশেষত কক্সবাজার কবিদের কাছে শুধু প্রকৃতির নয়, বরং মনের গভীর আবেগ ও ভাবনার প্রতিফলন।
গানে কক্সবাজারের রূপ:
বাংলা গানের জগতে কক্সবাজার এক অনন্য অনুষঙ্গ। আধুনিক গান, লোকগান কিংবা ভ্রমণকেন্দ্রিক গান—সব জায়গাতেই সমুদ্রের ঢেউ, আকাশের অসীমতা আর সৈকতের রোমান্স ধরা পড়ে। বিশেষ করে প্রেমের গানগুলোতে কক্সবাজার যেন ভালোবাসার নীরব সাক্ষী হয়ে ওঠে। বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক জনপ্রিয় গান কক্সবাজার সৈকতে ধারণ করা হয়েছে। ঢেউয়ের গর্জন, বালুর তটে হেঁটে যাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা সূর্যাস্তের রঙিন আভা গানগুলোকে দিয়েছে অন্যরকম আবেগ। এর ফলে কক্সবাজার শুধু দৃশ্যমান সৌন্দর্য নয়, বরং সংগীতের আবহ সৃষ্টিরও একটি প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
লোকসংগীতে কক্সবাজারের উল্লেখ আরও গভীর। রাখাইন ও আরাকানি জনগোষ্ঠীর লোকগানে সমুদ্র, মাছ ধরা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জেলেদের জীবনসংগ্রাম—সবই উঠে আসে। এসব গান কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং উপকূলীয় জীবনের সামাজিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির দলিল হিসেবে টিকে আছে। আধুনিক কণ্ঠশিল্পীরা যেমন তাদের গানের মিউজিক ভিডিওতে কক্সবাজারকে পটভূমি হিসেবে নিয়েছেন, তেমনি লোকশিল্পীরাও গেয়েছেন এই সমুদ্রের গান। এভাবে কক্সবাজার গানকে দিয়েছে রূপকথার আবহ, আবার গানও কক্সবাজারকে দিয়েছে চিরন্তন জনপ্রিয়তা।
চিত্রকলায় কক্সবাজার:
বাংলাদেশের চিত্রকলায় কক্সবাজার একটি বারবার ফিরে আসা বিষয়। সমুদ্রসৈকতের অসীম সৌন্দর্য, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের রঙিন আবহ, মাছধরা নৌকা কিংবা জেলেদের সংগ্রামী জীবন—সবকিছুই শিল্পীদের ক্যানভাসে জায়গা করে নিয়েছে। প্রখ্যাত শিল্পী জয়নুল আবেদীন তাঁর স্কেচে বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি জেলে ও উপকূলীয় জীবনের প্রতিচ্ছবিও দেখা যায়। সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে শাহাবুদ্দিন আহমেদ সমুদ্রের গতি-প্রকৃতি ও মানুষের সংগ্রামকে রঙের মাধ্যমে প্রাণবন্ত করেছেন। এছাড়া তরুণ শিল্পীদের বহু চিত্রপ্রদর্শনীতে কক্সবাজার সৈকতের সূর্যাস্ত ও বালুকাবেলা একটি জনপ্রিয় বিষয়।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে আয়োজিত বিভিন্ন আর্ট এক্সিবিশনে কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে আঁকা ছবি নিয়মিত প্রদর্শিত হয়। এসব ছবিতে সৈকতের নৌকা, জেলের জাল ফেলা, কিংবা বালিতে খেলা করা শিশুদের জীবনযাত্রা রঙের বিস্ময়কর টানে ধরা পড়ে। কেবল খ্যাতিমান শিল্পীরাই নন, কক্সবাজারের স্থানীয় শিল্পীরাও ক্যানভাস ও দেয়ালচিত্রে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। পর্যটন এলাকাগুলোতে আঁকা দেয়ালচিত্রে দেখা যায় ঢেউয়ের দৃশ্য, সাগরপাড়ের নারকেল গাছ, কিংবা মৎস্যজীবী পরিবারের সংগ্রামী জীবন। ফলে চিত্রকলায় কক্সবাজার শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়; বরং মানুষের শ্রম, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংস্কৃতিরও বহিঃপ্রকাশ হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, কক্সবাজার চিত্রকলার জগতে এক অনন্য প্রেরণার উৎস। প্রকৃতির রঙিন বৈচিত্র্য আর মানুষের জীবনের বাস্তবতা—দুটোই একসঙ্গে এখানে মিশে গেছে শিল্পীর তুলিতে।
চলচ্চিত্র ও নাটকে কক্সবাজার:
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাটকে কক্সবাজার দীর্ঘদিন ধরেই একটি জনপ্রিয় শুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বহুবছর ধরে চলচ্চিত্র নির্মাতারা সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়েছেন। যদিও পুরোনো মুভির রেফারেন্স তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া কঠিন, তবুও আমাদের সময়কার বেশ কিছু জনপ্রিয় ছবি যেমন “মনের মাঝে তুমি” (২০০৩), “ঢাকা অ্যাটাক” (২০১৭), “আয়নাবাজি” (২০১৬)-তে কক্সবাজারের সৈকত ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত অনেক টেলিফিল্ম ও নাটক, বিশেষ করে রোমান্টিক ধারার কাজগুলোতে কক্সবাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট হিসেবে হাজির হয়েছে। এখানে সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ভালোবাসা, স্বাধীনতা ও ভ্রমণের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। পর্যটন প্রচারের বিজ্ঞাপনচিত্রেও কক্সবাজারকে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা শুধু দর্শকের চোখে ভ্রমণের আকর্ষণ বাড়ায়নি, বরং শিল্পের মাধ্যমে অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করেছে।
লোককথা ও সংস্কৃতি:
কক্সবাজারের ইতিহাস ও লোককথাও শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিংবদন্তি আছে, ব্রিটিশ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, তাঁর নাম থেকেই জায়গার নামকরণ হয় কক্সবাজার। রাখাইন সম্প্রদায়ের গান, নৃত্য ও উৎসব সাহিত্য ও শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। স্থানীয় লোককাহিনিতে সমুদ্রের রহস্য, ঝড়ের ভয়াবহতা এবং জেলেদের বীরত্ব প্রাধান্য পেয়েছে। এসব কাহিনি একদিকে বিনোদন, অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্যের উপাদান হয়ে উঠেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, কক্সবাজার শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান নয়; এটি সাহিত্য ও শিল্পের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস। কবির কলমে, গায়কের কণ্ঠে, শিল্পীর তুলিতে আর চলচ্চিত্রের পর্দায় কক্সবাজার আজও জীবন্ত। প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবন মিলিয়ে এটি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডার।
লেখক: আদিল ইলাহি
শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।