লেখক ও কলামিষ্ট:
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আজ ভীতিকর এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সংবাদকর্মীরা যাদের হাতে জনগণের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার গুরুদায়িত্ব, তারাই হয়ে উঠছেন টার্গেট।
একদিকে গাছে ঝুলন্ত লাশের ছবি আমাদের বিবেক নাড়িয়ে দেয়, অন্যদিকে বিচারকের সামনেই সাংবাদিকদের মারধরের ঘটনা আমাদের আইন-আদালতের প্রতি আস্থা নড়বড়ে করে দেয়।
প্রশ্ন জাগে, সাংবাদিকদের জন্য দেশে নিরাপদ জায়গা আর কোথায়? সম্প্রতি কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত থেকে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হওয়া তরুণ সংবাদকর্মীর ঘটনা এখনো রহস্যে ঢাকা।
তদন্ত এগোয়নি, দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়নি। অথচ পরিবার ও সহকর্মীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
একই সময়ে আদালত প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে মারধরের শিকার হয়েছেন সংবাদকর্মীরা। আইনের সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থান আদালতেও যখন সাংবাদিকরা নিরাপত্তা পান না, তখন সাধারণ মানুষের কাছে এর বার্তা সুস্পষ্ট, বাংলাদেশে কলম ধরা মানে ঝুঁকি নেওয়া।
*সাংবাদিকরা আজ বহুমুখী নিরাপত্তাহীনতার শিকার।
*গুম, খুন ও হত্যার শিকার হচ্ছেন।
*বিভিন্ন আইনের অপব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হচ্ছে।
*রাজনৈতিক ক্যাডার ও সন্ত্রাসীরা হামলা করছে।
*আর্থিকভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছে বিজ্ঞাপন বন্ধ বা চাকরিচ্যুতির মাধ্যমে।
*এ যেন এক পরিকল্পিত ভয়ের সংস্কৃতি, যার উদ্দেশ্য সাংবাদিকদের নীরব করে দেয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র কি সত্যিই সাংবাদিকদের সুরক্ষা দিতে চায়? বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি, প্রশাসনের নীরবতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রমাণ করে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সমাজও কম দায়ী নয়। সত্য প্রকাশে সাহসী সাংবাদিককে যখন সমর্থন না দিয়ে একঘরে করে দেওয়া হয়, তখন সত্য হারায়, মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাংবাদিকদের কলম শুধু পেশার হাতিয়ার নয়; এটি জনগণের চোখ-কান, গণতন্ত্রের ভিত্তি। তাই সাংবাদিকদের রক্ষা মানে আসলে মানুষের কণ্ঠকে রক্ষা করা। এই লড়াই সাংবাদিকদের একার নয় – রাষ্ট্র, সমাজ, নাগরিক সবাইকে এতে অংশ নিতে হবে।
*সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সংগঠনগুলোকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
*জনগণকে বুঝতে হবে, সাংবাদিককে আক্রমণ মানে তাদের নিজের অধিকারকে আক্রমণ।
*রাষ্ট্রকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ হতে হবে। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে তরুণ প্রজন্ম সাংবাদিকতায় আসতে চাইবে না। কলমের জায়গা দখল করবে ভয়, আত্মসমর্পণ ও প্রচারণা।
একটি রাষ্ট্র যেখানে সাংবাদিকতা নিস্তব্ধ হয়ে যায়, সেখানেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ জন্ম নেয়। সাংবাদিকদের হত্যা, ঝুলন্ত লাশ আর প্রকাশ্য আদালতে মারধর, এই তিনটি চিত্রই স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ আজ ভয়ঙ্কর এক নিরাপত্তাহীনতায় আছে।
এখন যদি রাষ্ট্র ও সমাজ একযোগে প্রতিবাদে দাঁড়ায়, তবে হয়তো কলমকে বাঁচানো সম্ভব। নচেৎ ইতিহাস সাক্ষী হয়ে থাকবে, আমরা নিরবে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, কিভাবে কলমকে হত্যা করা হয়েছিল।
কলমে,
শাকুর মাহমুদ চৌধুরী
সংবাদকর্মী ও কলামিস্ট – উখিয়া, কক্সবাজার।
সাংগঠনিক সম্পাদক – জাতীয় অনলাইন প্রেস কাউন্সিল কেন্দ্রীয় কমিটি ঢাকা।