সিলেট বিআরটিএ অফিস অনিয়ম-দুর্নীতি’র কারখানা!

প্রকাশিত: ১:৩৯ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪

সিলেট বিআরটিএ অফিস অনিয়ম-দুর্নীতি’র কারখানা!

ক্রাইম প্রতিবেদক: অনিয়ম আর দুর্নীতি! কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আত্মীয় পরিচয়ে বিআরটিএ সিলেট সার্কেলের সহকারী পরিচালক রিয়াজুল ইসলাম ও মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারী । তাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক নেতা, সাধারণ জনতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষসহ বিভিন্ন সংগঠনের নানান অভিযোগ থাকা স্বত্ত্বেও নিজেদেরকে টক অব অফ দ্যা বিআরটিএ বানিয়েও চাকরি করছেন বহাল তবিয়তে।

 

বিগত সরকারের আমলে সিলেট যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ আলী, পিংকু, ইমন, উত্তম, মনসুরকে ক্যাশিয়ার বানিয়ে সার্ভার থেকে পুরোনো নথি গায়েব,রেজিস্ট্রেশন-ফিটনেস-লাইসেন্স শাখা ঘুষ বাণিজ্যসহ সেবা নিতে আসা জনগণকে জিম্মি করে বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য আর অর্থ আত্মসাতে নিজেদেরকে সিদ্ধহস্ত করেছেন বহুগুণীয় রূপে।

 

বারী-রিয়াজুল নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও গত ১৪ আগস্ট অবসরে যাওয়া বিআরটিএ সচিব আমিন উল্লাহ নূরীর ছত্রছায়ায় থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ বহাল তবিয়তে রয়েছেন সিলেট সার্কেলে। তাই ঝাড়ুদার থেকে পিয়ন সবই যেন তাদের নখদর্পনে। বেসামাল কর্মকাণ্ডে যেন নিজেদের এগিয়ে নিয়ে গেছেন বহুদূর। বিআরটিএর কর্তাও বনে গেছেন তার শিষ্য দালালরা।

 

সূত্র জানায়- রিয়াজুল মোটরযান পরিদর্শক হিসেবে ২০১১ যোগদান করে নানা অভিযোগে ২০১৩ সালে বদলী হন। তিনি প্রভাব খাটিয়ে ২০১৯ সালে পুনরায় যোগদান করেন। এরপর ২০২০ সনের ১২ এপ্রিল বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের এক আদেশে তৎকালীন সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার সানাউল হককে সিলেট সার্কেল থেকে মাগুরায় বদলি করা হয়। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে রিয়াজুল ইসলাম উপর মহলে তদবীর করে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.১০৬.২০-৬৩১ নং আদেশ মূলে বিআরটিএ সিলেট ও সুনামগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে নেন।

 

অপরদিকে ম্যাকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে আব্দুল বারী ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত সিলেট সার্কেলে কাজ করেন। ঘুষ দূর্নীতির অভিযোগে তাকে বদলী করা হয়। কিন্তু রিয়াজুল বিআরটিএ এর প্রশাসন বিভাগকে ম্যানেজ করে ২০ মাসের মাথায় ২০২২ সালের ১৮ মে ৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.১০৬.২০-৮০৭ নং স্বারকে বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেল থেকে সিলেট সার্কেলে বদলী হয়ে আসেন। যারফলে সিলেট সার্কেলের মেক্যানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট সাদিকুর রহমানসহ দালালরা মিলে সিলেট বিআরটিএ-তে তৈরি করেন ঘুষ বাণিজ্য ও অনিয়ম দুর্নীতি।

 

তথ্যানুযায়ী- সিলেট জেলায় রেজিস্ট্রেশনকৃত সিএনজিচালিত অটেরিকশার সংখ্যা ২১ হাজার ২৩২টি।(২০২২ সাল) ২ অক্টোবর মেট্রো আরটিসির সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সিলেট জেলার ঠিকানায় রেজিস্ট্রেশনকৃত অটোরিকশার মালিকরা মেট্রো ঠিকানায় বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) রিয়াজুল ইসলাম প্রতিটি অটোরিকশা থেকে ৫০/৬০ হাজার টাকা নিয়ে এমআরটিসির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অবৈধভাবে মালিকানা বদলি করেন। মালিকানা বদলির বিষয়টি সিলেট অটোরিকশার মালিক ও অন্যান্য ব্যক্তি অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে জানাজানি হওয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কেবল দুই মাসে প্রায় ৫৫টি অটোরিকশার মালিকানা বদলি জেলা থেকে মেট্রোতে করার বিষয়টি ধরা পড়ে। এর মধ্যে সিলেট-থ-১১ সিরিয়ালের ২১টি ও সিলেট-থ-১২ ডিজিটের নাম্বার প্লেটের ৩৪টি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন দিয়ে প্রতিটি থেকে প্রায় ৫০/৬০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে। অনৈতিক সুবিধা নিতে প্রায় ১৮ বছর আগের পুরোনো সিলেট-থ ১১ নাম্বার প্লেটের অটোরিকশার মালিকানা বদলি করা হয়। প্রায় ২০০ এর অধিক গাড়ির জেলা থেকে নগরে মালিকানা পরিবর্তন করে আনা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা নিবন্ধনের নামে ৬০ কোটি টাকা লোপাট করেন এই ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালরা।

 

ভোক্তভোগীরা জানান- বায়োমেট্রিক সেকশন থেকে শুরু করে মালিকানা ট্রান্সফার, গাড়ি শনাক্ত করা সব ক্ষেত্রেই দালাল ও টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স বোর্ডে দালাল মারফত না গেলে গ্রাহক যদি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বরও পান, এর পরও তাকে ফেল করানো হয়। যেকোনো ধরনের কাজের জন্য সিলেট বিআরটিএতে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। কিন্তু ফাইল জমা দেয়ার আগের দিন কাগজপত্র নিয়ে বিআরটিএ অফিসে গিয়ে একটি মার্ক করা লাগে। এই মার্ক করতে মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এস এম সামিউল ইসলামের মাধ্যমে ঘুষের টাকা নেওয়া হয়। এরপর দালালদের মাধ্যমে কাগজপত্রে ঘুষের মার্ক করানো লাগে। কাগজে মার্ক করা হয় ১, ২, ৩ করে। মানে এক হলে ১ হাজার টাকা, দুই হলে ২ হাজার টাকা। এক-পাঁচ দিলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। গাড়িতে কোনো সমস্যা থাকলে সেটিও দালালের মাধ্যমে অবজেকশন দেওয়ানো হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার বিনিময়ে। লাইসেন্সপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার। অস্থায়ী ফিঙ্গার রোলের জন্য দিতে হয় ১ হাজার টাকা। সরকারি ফির বাইরে সিলেট বিআরটিএ ভবনের ৩২৩ নম্বর রুমে কোন চাকুরী ছাড়াই বসেন মোহাম্মদ আলী। সেখানে ফিটনেস পরীক্ষায় প্রতি সিএনজি বাবদ ঘুষ রাখা হয় ২ হাজার টাকা, বড় গাড়ি ৩ হাজার, ট্রাক সাড়ে ৪ হাজার টাকা। ফলে সিলেট বিআরটিএ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালের যোগসাজশে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কয়েক বছর আগে প্রিন্টিংয়ের জন্য ব্যবহৃত ‘ডুয়েল ইন্টারফেজ পলিকার্বনেট’ ড্রাইভিং কার্ড না থাকায় বিআরটিএ অফিসে প্রায় পাঁচ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফাইল জমা পড়ে। ওই সময় কাউকে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এখন এই পাঁচ হাজার ফাইল গায়েব হয়ে গেছে। ফাইলের সঙ্গে গায়েব হয়েছে লাইসেন্সের ফি। তাই এখন সেবাগ্রহীতাদের আবার নতুন করে টাকা দিয়ে আবেদন করতে হচ্ছে।

 

সিলেটের বিভিন্ন সংগঠন ও ভোক্তভোগীরা জানান- চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলা সিএনজি চালিত অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাকারিয়া বিআরটিএ চেয়ারম্যান বরাবরে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ এনে আবেদন করেন। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন হলেও রিয়াজুল-বারী সিন্ডিকেট প্রভাব খাটিয়ে তা গাঁয়েব করেন। এর পূর্বে সিলেটের সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষে বিআরটিএ সচিব বরাবরে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এমকে রায়। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতেও তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছরের মার্চ মাসে সিলেট জেলা প্রশাসক বরাবরে একইভাবে আবেদন করেন ভোক্তভোগী আ.ন.ম ইসহাক। ওই আবেদনেরও কোন সুরাহা হয়নি। রিয়াজুল-বারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমা হয়ে গেলেও এখনো তারা বহাল তবিয়তে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই এখন বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও অপসারণের দাবি তুলেছেন তারা।

 

সিলেট জেলা সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ দিলোওয়ার জানান- বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সিলেট অফিসের সব সেবা ঘুষ, দুর্নীতি ও দালালচক্রে আটকা পড়েছে। ঘুষ না দিলে এখানে কোনো কাজ হয় না। দালাল পরিবেষ্টিত এ অফিসে দীর্ঘদিন ধরে থাকা কিছু অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের ‘বিশ্বস্ত দালালচক্র’ তৈরি করেছেন। তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছেন এই অফিসের সেবাপ্রার্থীরা। ফলে ক্ষোভে ফুঁসছেন সিলেটের জনসাধারণ। তারা সিলেট বিআরটিএ এর কর্মকর্তা কর্মচারীদের অপসারণ চান। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলন করা হবে।

 

সহকারী পরিচালক রিয়াজুল জানান- তার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ লেগেছে। তিনি অবৈধ কোন কিছুতে যুক্ত নন। আর আলী, মনসুর, পিংকুসহ যারা কার্যালয়ে ছিল, বর্তমানে তারা নেই। তিনি সিলেটে বার বার বদলী হয়ে আসেন কেন.? প্রশ্ন করলে তিনি দেখে নেওয়ার হুমকি প্রদান করেন।

 

গত ১৪ আগস্ট অবসরে যাওয়া বিআরটিএ সচিব আমিন উল্লাহ নূরী জানান- বিধি মোতাবেক দুই বছরের বেশী কেউ এক স্থানে থাকার কথা না। তবে বিষয়টি ভালো জানেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান। আর কেউ ঘুষ, দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকলে দুর্নীতি দমন কমিশনে ধরিয়ে দেয়ার কথা বলেন।

 

মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব, এডিপি শাখার দায়িত্ব প্রাপ্ত আব্দুল্লাহ-আল-মাসুদ জানান- তিনি পোস্টিং বা বদলির দায়িত্বে নন। তবে এতো অভিযোগ ও এক স্থানে দীর্ঘদিন থাকার বিষয়টি চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে আলাপ করে রিয়াজুল ইসলাম ও আব্দুল বারীকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের চেয়ারম্যান গৌতম চন্দ্র পাল জানান- সিলেট বিআরটিএ সার্কেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে খুব দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ