সিলেটে ‘বুঙ্গার চিনি’ চোরাচালান এখনও ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে!

প্রকাশিত: ১২:১৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৪

সিলেটে ‘বুঙ্গার চিনি’ চোরাচালান এখনও ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে!

ক্রাইম প্রতিবেদক: সিলেটে একের পর এক ধরা পড়ছে ভারতীয় চোরাই চিনির চালান। একেক অভিযানে ধরা পড়ছে কোটি টাকার চিনি। এর পরও থামছে না চোরাচালান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক নজরদারির কারণে চোরাকারবারিরা প্রতিনিয়ত পাল্টেছে কৌশল। বুঙ্গার চিনি গন্তব্যে নিয়ে আসতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। ট্রাক ভর্তি চিনির ওপর পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য রেখে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমন কয়েকটি চালান আটক হলে বিষয়টি নজরে আসে।

 

দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিলেটে চিনি চোরাচালানের সিন্ডিকেটের গডফাদার হরিপুরের আবুলের হাতবদল হলেও এখন সিলেটের বুঙ্গার চিনি চোরাচালানের নিয়ন্ত্রকের গডফাদার হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন তাৎক্ষণিক সিন্ডিকেট প্রধান আবুলের সহযোগী ৫নং ফতেপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বার। আর তার সহযোগী হিসেবে গুরুত্বর ভূমিকা পালনে নিয়োজিত রয়েছেন সাবেক ওই সিন্ডিকেটের গডফাদার আবুলের ডান হাত পান্না ও বাম হাত সুহেল। তারা কালো টাকার গন্ধে একসময়ের সিন্ডিকেটের গডফাদার আবুলকে ধোঁকা দিয়ে বর্তমান সিন্ডিকেটের গডফাদার রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের সহযোগী হিসেবে তাদের রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বর্তমান গডফাদার রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের অদৃশ্য শক্তির কাছে জিম্মি জৈন্তাপুর ও শাহপরান থানা’র পুলিশ! তবে বর্তমান গডফাদার রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের অদৃশ্য শক্তির কারণ হচ্ছে তিনি জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির বাগনা হওয়ার সুবাধে। আর এখন গডফাদার রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের যুবদল ও ছাত্রদলের কতিপয় কয়েকজন নেতার সাথে গভীর দহরমমহরম থাকার আর্শীবাদে তিনি ছাত্রলীগ নেতা হয়েও গোটা সিলেটের বুঙ্গার চিনি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ।

 

একাধিক চোরাকারবারিদের দেওয়া তথ্যমতে, ক্ষমতার পালাবদলের পর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেলেও গডফাদার রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের যুবদল ও ছাত্রদলের কতিপয় কয়েকজন নেতার সাথে গভীর দহরমমহরম থাকার সুযোগে গোটা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেন তিনি। আর তার নেতৃত্বেই এখন সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাই চিনি ট্রাকে করে এনে নিরাপদে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে। এর বিনিময়ে যুবদল ও ছাত্রদলের কয়েকজন নেতারাও মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন বলে সুত্র বলছে।

 

সিলেট সীমান্তে এখন চিনি চোরাচালানের গডফাদার রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের চোরাই চিনির রমরমা কারবার চলছে আর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) দক্ষিণ বিভাগের তিনটি থানা এলাকায় চলছে চোরাই চিনির গাড়ি (ট্রাক, মিনি ট্রাক) ছাড় দেওয়ার আরেক বাণিজ্য। চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চোরাই চিনির গাড়ি ছাড় দিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা কামানোর অভিযোগ রয়েছে কয়েকজন খোদ পুলিশের বিরুদ্ধে। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত চলে গাড়ি ছাড়ের এই মহোৎসব। এর মধ্যে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পর ৭ জুন থেকে এসএমপির গোয়েন্দা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরপাকড়ের মধ্যে দিয়েও এখনও চলেছে দক্ষিণের তিনটি থানায় চিনি চোরাচালানের গডফাদার রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের চোরাই চিনির গাড়ি ছাড় দেওয়ার ঘটনা।

 

সিলেট মহানগরীতে এসএমপির ছয়টি থানা। এর মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুটো ভাগে দায়িত্ব সাজানো রয়েছে। দুজন উপকমিশনারের মাধ্যমে ছয়টি থানা পরিচালিত হয়। দক্ষিণ ভাগে পড়েছে তিনটি থানা। ওই তিন থানা এলাকার সঙ্গে সিলেটের সীমান্ত এলাকার রয়েছে সহজ সড়ক যোগাযোগ। চোরাই চিনির গাড়ি সরাসরি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে পৌঁছাতে এসএমপির দক্ষিণের থানাগুলো অতিক্রম করতে হয়।

 

অভিযোগ রয়েছে, এ সুবিধাকে পুঁজি করে চোরাই চিনির গাড়ি ছাড় দিয়ে নগরী পাড় করে দেওয়ার কাজটি অধীনস্থদের দিয়ে একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন এসএমপির সাবেক উপকমিশনার (ডিসি, সাউথ) সোহেল রেজা। গত বছরের নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এসএমপির দক্ষিণ বিভাগের থানাগুলোতে কর্মরত ২১ জন পুলিশ সদস্যের ফোন নম্বরে উপকমিশনার সোহেল রেজার অফিশিয়াল ফোন থেকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে কেবল চোরাই চিনির গাড়ি ছাড় দিয়ে টাকা আদায়ের হিসাব পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে একাধিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। তবে কি চিনি চোরাচালানের গডফাদার রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের সঙ্গে যোগসাজশে এসএমপির সাবেক উপকমিশনার (ডিসি, সাউথ) সোহেল রেজার দেখানো পথে হাঁটছেন এসএমপির নবাগত উপকমিশনার (ডিসি, সাউথ)? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সচেতন মহলে।

সীমান্তবর্তী এলাকার একাধিক বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার চিনি আসে। এসব চিনি তামাবিল-জৈন্তাপুর-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ভোলাগঞ্জ-কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে নগরের পাইকারি বাজার কালীঘাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। আগে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের অনুসারীরা পাহারা দিয়ে প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত চোরাই চিনির ট্রাক শহরে ঢোকাতেন। এখন এ চিনি চোরাচালানের গডফাদার রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের নেতৃত্বে হাতবদল ঘটেছে।

 

খাদিমপাড়া এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দা জানান- যেসব ট্রাকে চিনির বস্তা পাওয়া যাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। আর যেসব ট্রাকে চিনি নেই, সেসব ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা টাকা আদায় করছেন, তাঁরা নিজেদের যুবদল ও ছাত্রদলের কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছেন। তবে তাঁরা যুবদল কিংবা ছাত্রদলের কোন নেতাদের অনুসারী, সেটা জানা যায়নি।

 

একাধিক সূত্রের তথ্যমতে- মধ্যরাত থেকে ভোরের মধ্যে দুটি আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে ট্রাক ও পিকআপে চোরাই চিনি সিলেটে ঢোকে। গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও জৈন্তাপুর সীমান্তের চিনি তামাবিল-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট (একাংশ) সীমান্তের চিনি রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের হাত ধরে ভোলাগঞ্জ-কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে সিলেটে আসে। এসব মহাসড়ক দিয়ে চিনি এখন ট্রাকপ্রতি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকায় পার করিয়ে দিচ্ছে রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের অনুগত কিছু সংখ্যক যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের কয়েকটি সিন্ডিকেট।

 

একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট শহরে ঢোকার পর অধিকাংশ চিনি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাকে করে যায়। এসব ট্রাক দক্ষিণ সুরমার বাইপাস এলাকাসহ কিছু স্থানে আটকিয়ে যুবদল ও ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মী আরেক দফা ট্রাকপ্রতি চাঁদা আদায় করে থাকেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের অনুপস্থিতির সুযোগে এ চাঁদাবাজি এখন অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে পড়েছে।

 

এ বিষয়ে রুবেল শরীফ ওরফে রুবেল মেম্বারের ব্যবহৃত সেলফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান- আমি চিনির ব্যবসার সাথে জড়িত না, আমি একজন কন্টাক্টদার এবং একটা চক্র ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।

 

এ বিষয়ে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানান- ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কড়া নির্দেশনা রয়েছে। বিএনপি কিংবা অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে যে বা যারা অপকর্ম অথবা অপরাধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব, যুবদল কিংবা ছাত্রদলের কারও বিরুদ্ধে চিনি চোরাচালানে জড়িত থাকার সম্পৃক্ততা পেলে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া পুলিশকেও অনুরোধ করব, এমন অভিযোগ পেলে যেন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ