১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন মাদক ও অবৈধ কর্মকান্ডের স্টেশন!

বাংলা বারুদ
প্রকাশিত আগস্ট ২৬, ২০২৫, ০৯:০৫ অপরাহ্ণ
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন মাদক ও অবৈধ কর্মকান্ডের স্টেশন!

Manual5 Ad Code

নিজস্ব প্রতিনিধি। তমাল চন্দ্র দে রুদ্র।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম রেলস্টেশন এলাকা যেন মাদক কেনাবেচার হাটে পরিণত হয়েছে। নতুন স্টেশন, পুরাতন স্টেশনের ভেতরে-বাইরে, এমনকি প্লাটফর্মেও চলে মাদকের খোলামেলা কেনাবেচা। এমনকি ট্রেনে করেও প্রতিনিয়ত পাচার করা হয় বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। গত দুই মাসে ১৭টি মাদক মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতেও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও কমছে কারবারিদের ব্যবসা।

চট্টগ্রাম রেলস্টেশন যেন মাদক কেনাবেচার হাট, সন্ধ্যা নামতেই রমরমা দিনের বেলায়ও চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের আশপাশে উঠতি বয়সের ছেলেরা মাদকসেবন ব্যস্ত হয়ে ওঠে (বামে)। রাতে স্টেশনে মাদক বিক্রয়রত অবস্থায় চিহ্নিত কারবারি নুরুল কবির।

অভিযোগ উঠেছে, গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) কিছু অসাধু সদস্য এসব মাদক কারবারে জড়িত। ইয়াবাসহ যাত্রী আটক করা হলেও চালান দেওয়া সংখ্যা কম দেখিয়ে। পরে ওসব ইয়াবা মাদক কারবারির মাধ্যমে কেনাবেচা করা হয়।

সরেজমিন রেলস্টেশন এলাকায় দেখা গেছে, অবাধে মাদক সেবন করছেন অনেকে। এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসেছে গাঁজা ও জুয়ার আসর। বিশেষ করে সন্ধ্যা হতেই আরও রমরমা হয়ে ওঠে মাদক কেনাবেচা। অনেকে রাতের আঁধারে প্রকাশ্যে ফেনসিডিল কিনছেন রেললাইনঘেঁষা বিভিন্ন ঝুপড়ি থেকে। বেশ কয়েকজনকে দেখা গেছে মাদক নিয়ে গ্রাহকের অপেক্ষায় থাকতে।

এর মধ্যে দুইজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা দ্রুত সটকে পড়ে। এসব মাদক কারবারিদের ওপর একসময় রেল শ্রমিক লীগ নেতাদের ছায়া থাকলেও এখন সেই কাজ করছেন রেল শ্রমিক দলের বেশকিছু নেতা।

Manual6 Ad Code

এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট চট্টগ্রামের রেলওয়ে থানার সামনে প্লাটফর্মে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করছেন কবির হোসেন (৫০) নামে এক কারবারি। তার মাদক বিক্রির ছবি তোলা হলে তাতে পেছনেই দেখা গেছে রেলওয়ে থানার অবস্থান।

রেল পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদস্যরা যেন দেখেও দেখেন না। ২০ হাজার ইয়াবা হয়ে গেল ১২০০ চলতি বছরের ২৫ জুন চটগ্রাম নগরীর ষোলশহর স্টেশনে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ট্রেনে আসাদুজ্জামান ( ৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে ইয়াবাসহ আটক করেন রেল পুলিশের উপ-পরিদর্শক আরব আলী। তার কাছ থেকে ২০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হলেও আদালতে চালানের সময় সে সংখ্যা হয়ে যায় ১২০০ পিস। এমনকি আদালতে আসামি নিজেই ২০ হাজার পিস ইয়াবার কথা স্বীকার করেন।

ওই ঘটনায় দুইজনকে স্বাক্ষী করা হয়। তাদের একজন ট্রেন স্টুয়ার্ড পারভেজ এবং অপরজনের নাম বাবুল। কিন্তু স্বাক্ষী করা হলেও কত পরিমাণ মাদক উদ্ধার করা হয়েছে, তা তাদের দেখতে দেননি এসআই আরব আলী। একজন ট্রেনে গার্ড পুলিশ (টিজি পুলিশ) নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কত পিস ইয়াবা জব্দ করেছে, তা না দেখিয়ে যাত্রীকে তুলে নিতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। তখন এসআই আরব আলীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়।

এরপর ২০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের বিষয়টি জানতে পারি। বিষয়টি পুলিশ সুপার পর্যন্ত গড়ালে মৌখিক তদন্ত আদেশ দেওয়া হয়। মাদক কারবারি আসাদুজ্জামান রাজশাহীর গোদাগারীর আজুয়া গ্রামের মৃত তৈয়বুর রহমান ছেলে।

তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি শুধু ট্রেনে নয়, বাসের মাধ্যমে মাদক পাচার করে থাকেন। ট্রেনে ভ্রমণের সময় তিনি এক নারীর রেজিস্ট্রেশন করা আইডি ব্যবহার করে টিকিট কাটেন। এভাবে ২৫ জুন ছাড়াও ২৯ মার্চ, ১২ ফেব্রুয়ারি ও জানুয়ারি মাসে দুইবার ট্রেন ভ্রমণ করেন। দুই মাসে ১৭ মাদক মামলা চট্টগ্রামের রেলওয়ে থানায় দুই মাসে ১৭টি মাদক মামলা দায়ের হয়েছে।

Manual7 Ad Code

এসব মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে চালান করা হয়েছে। কিন্তু আদালতে পাঠানো হলেও জামিনে বেরিয়ে ফের রেলস্টেশন এলাকায় মাদকের কারবারে জড়িয়ে পড়ে অপরাধীরা। গত ২১ জুন বিকাল পৌনে ৬টার দিকে চিনকী আস্তানা রেলওয়ে স্টেশনে থাকা চট্টগ্রামগামী কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের ‘ক’ বগির মাঝামাঝি স্থান থেকে সেলিনা আক্তার ওরফে রিয়া নামে এক মাদক কারবারিকে আটক করা হয়।

রিয়ার ডান হাতে থাকা কালো রংয়ের কাপড়ের ব্যাগের ভেতর থেকে ৪টি পোটলা থেকে ৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে পাহাড়তলীর রেলস্টেশন এলাকা থেকে গাঁজা ও ফেনসিডিলসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৭। গ্রেপ্তার দুইজন হলেন— মো. আজিম উদ্দিন (২৩) ও মো. সৌরভ চৌধুরী (২৮)। তাদের হাতে থাকা শপিং ব্যাগ তল্লাশি করে স্কচটেপ মোড়ানো ১০ কেজি এবং ১২২ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে মাদক পাচারের অন্যতম নিরাপদ রুটে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। কক্সবাজার থেকে সহজেই ট্রেনে করে মাদক চলে আসেন নগরে। এরপর এখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। এই রুটে লাগেজ স্ক্যানারসহ যাত্রী তল্লাশি ব্যবস্থা না থাকায় সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছেন কারবারিরা।

চট্টগ্রামের রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদ উল্লাহ জানান, গত দুই মাসে ১৭টি মামলা হয়েছে। মাদক মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তারের পর আদালতে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গতবছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে চট্টগ্রামের রেলওয়ে থানা মাদকের মামলা হয়েছে ২৬টিম গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৩ জন। ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ১২ হাজার ৩৮০ পিস, গাঁজা ৪৪ কেজি। ‘টিকিট কালোবাজারি’ নির্দোষ!

Manual3 Ad Code

চলতি বছরের ২৮ মে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে অভিযানে গিয়ে টিকিট কালোবাজারির সত্যতা পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানে রেলের বুকিং সহকারী, নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্যসহ তিনজনের বিরুদ্ধে বাড়তি দামে টিকিট বিক্রির অভিযোগ পায় দুদক। তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে দুদক।

তখন দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, রেলের তিনকর্মী ১৯০ টাকার টিকিট বিক্রি করছিলেন ৩০০ টাকায়। টিকিট সংগ্রহ করেননি এমন যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রি করছিলেন। এসব টিকিট তাদের হাতে থাকার কথা নয়।

Manual5 Ad Code

অভিযান পরিচালনার সময় দুদকের অভিযান দলের সদস্যরা ছদ্মবেশে টিকিট সংগ্রহের চেষ্টা করলে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন। স্টেশনে দায়িত্বরত আরএনবির সদস্যরা বুকিং সহকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে টিকিট কালোবাজারির কাজগুলো করছিলেন।

এছাড়া গত ৬ জুন দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনে ১৮ জনের হাতে চট্টগ্রাম রেলের টিকিট বাণিজ্য, মূল হোতা আরএনবি সদস্যরা—শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে রেল পুলিশের দুই কনস্টেবল কালাম ও বিল্লালের টিকিট কালোবাজারিতে যুক্ত বলে উঠে আসে।

এরপর তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেন রেলওয়ে পুলিশ সুপার। ৩১ জুলাই সহকারী পুলিশ রেদোয়ানের দেওয়া সেই রিপোর্টে কালাম ও বিল্লালকে নির্দোষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

তবে সহকারী পুলিশ সুপার জিআরপি আতিকুর রহমান জানান, কালামের বিরুদ্ধে টিকিট কালোবাজারি সংশ্লিষ্ট আরেকটি অভিযোগের তদন্তের ভার তার হাতে।এতে কালামের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ রয়েছে এবং শিগগিরই তিনি তদন্ত রিপোর্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জমা দেবেন।