১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

অবহেলা ও যত্নে জর্জরিত সেতাবগঞ্জ চিনিকল

বাংলা বারুদ
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫, ০৩:৫৫ অপরাহ্ণ
অবহেলা ও যত্নে জর্জরিত সেতাবগঞ্জ চিনিকল

Manual6 Ad Code

মোঃ আসাদ আলী

দিনাজপুর জেলার একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান সেতাবগঞ্জ চিনিকল এক সময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও এখন নিস্তব্ধ ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে। কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে থেকে মরিচা ধরছে, নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান মেশিনারি। পাঁচ বছর ধরে বন্ধ থাকায় রুদ্ধ হয়েছে হাজার হাজার মানুষের জীবিকার পথ। শ্রমিক-কৃষকের স্বপ্ন আজ ভেঙে পড়েছে। অথচ সরকারের বরাদ্দ থাকা সত্বেও অর্থ ছাড় না পাওয়ায় মিলটি চালু করা যাচ্ছে না।

জানা যায়, চিনিকলটিতে আবারও আখ মাড়াই কার্যক্রম চালু করার দাবিতে সেতাবগঞ্জ চিনিকল পুনঃ চালনা আন্দোলন পরিষদ ২০২০ সাল থেকে আন্দোলন করে যাচ্ছে। বরাদ্দ আছে, অর্থ ছাড় নেই: অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় ছয়টি চিনিকলের আখ মাড়াই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে সেতাবগঞ্জ ও রংপুরের শ্যামপুর চিনিকল চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। শিল্প উপদেষ্টা, সচিব, চিনি করপোরেশনের চেয়ারম্যান এরই মধ্যে সেতাবগঞ্জ মিল পরিদর্শনও করেছেন।

Manual4 Ad Code

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো সংস্কারের জন্য প্রথম ধাপে বরাদ্দকৃত ৭২ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় হয়নি। ফলে সংস্কার কাজ শুরুই করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আখ চাষে ভাটা, থমকে গেছে কর্মসংস্থান: সেতাবগঞ্জ চিনিকলের মোট জমি তিন হাজার ৮৬২ একর। এর মধ্যে এক হাজার ৩০০ একরে আখ রোপণ করা হলেও তা ঠাকুরগাঁও চিনিকলে পাঠানো হচ্ছে।

এক হাজার ৬৩৭ একর জমি কৃষকদের লিজে দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৪ থেকে ১৫ কোটি টাকা আয় হয়। কিছু জমিতে শালবাগান, আমবাগান, ড্রাগনবাগানও রয়েছে। চিনিকল বন্ধ থাকায় নিয়মিত ২৭৫ জন, মৌসুমি ৩০০ জনকে অন্য চিনিকলে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক এবং দৈনিক মজুরির প্রায় এক হাজার শ্রমিক কার্যত বেকার হয়ে গেছে। আখ চাষিরাও হতাশ।

বর্তমানে যে আখ উৎপাদন পাঁচ বছর ধরে বন্ধ থাকায় রুদ্ধ হয়েছে হাজার হাজার মানুষের জীবিকার পথ সংস্কারের জন্য প্রথম ধাপে সরকারের বরাদ্দকৃত ৭২ কোটি টাকা ছাড় হয়নি। অথচ মিলের তিন হাজার একর জমিতে আখ চাষ হলে কারখানাটি ৬০ দিন চালানো যেত। এদিকে দীর্ঘদিন মিল বন্ধ থাকায় কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তবে এবার খুব অল্পসংখ্যক মানুষ মিলের জমিতে আখ রোপণ করেছে। যা দিয়ে মিলটি স্বল্প সময়ের জন্য চালু করা সম্ভব।

ঐতিহাসিক শিল্প আজ মরিচা ধরা স্মৃতি: দিনাজপুর অঞ্চলের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৩ সালে। ভারতের নাগরমল ও সুরজমল আগরওয়ালা ইন্দোনেশিয়া থেকে আট হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন পুরনো যন্ত্রপাতি এনে মিল স্থাপন করেছিলেন। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এটি মাড়োয়ারিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

পাক-ভারত ভাগ হলে সময় তারা দেশ ত্যাগ করলে পাকিস্থান সরকার এর দায়িত্ব নেয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মিলের যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালে লে-অফ ঘোষণা করা হলেও স্থানীয়দের আন্দোলন, বিশেষ করে তেভাগা আন্দোলনের নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশসহ অনেকের প্রচেষ্টায় ১৯৮২ সালে আধুনিক যন্ত্রপাতি বসিয়ে মিল আবার চালু করা হয়।

Manual4 Ad Code

কিন্তু ২০২০ সাল থেকে সেতাবগঞ্জ চিনিকল পুনঃ চালনা আন্দোলন পরিষদ দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবি, মিল চালু না করলে এ অঞ্চলের কৃষক-শ্রমিকরা ধ্বংস হয়ে যাবে। শ্রমিক-কৃষকের কণ্ঠে আক্ষেপ: অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানিয়ে চিনিকল পুনঃ চালনা আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক বদরুদ্দোজা বাপন বলেন, এ মিল বেসরকারকিরণ করবেন না।

Manual5 Ad Code

দিনাজপুর অঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান সেতাবগঞ্জ চিনিকলকে দ্রুত অর্থ ছাড় দিয়ে সংস্কার করে চালু করুন। আখ চাষি আব্দুল জব্বার বলেন, ‘আমি মিল চালুর আশায় আখ চাষ করেছি। যদি চালু হয়, অন্য কৃষকও আখ চাষে ফিরবে।

এতে কর্মসংস্থান বাড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্য জমবে, দেশের চিনির ঘাটতিও পূরণ হবে। শেষ ভরসা সরকারের সিদ্ধান্ত: সেতাবগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ আবুল বাশার বলেন, বর্তমানে চিনিকলের এক হাজার ৩০০ একর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে। এই আখ মাড়াইয়ের জন্য ঠাকুরগাঁও চিনিকলে দেওয়া হয়। এক হাজার ৬৩৭ একর জমি সাধারণ মানুষের কাছে কৃষি আবাদের জন্য লিজ নিয়ে বছরে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ কোটি টাকা আয় করছে। সেতাবগঞ্জ চিনিকল সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বাজেট পাস হয়েছে।

এদিকে প্রথম ধাপে বরাদ্দকৃত ৭২ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় না দেওয়ায় এখনো সংস্কারকাজ শুরু করা যায়নি। বরাদ্দকৃত অর্থ পেলে চিনিকলের সংস্কারকাজ শুরু করা যাবে।’ সেতাবগঞ্জের জমি, পরিবেশ ও প্রকৃতি আখ চাষের উপযোগী। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, কৃষক তত আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

যদি দ্রুত অর্থ ছাড় না হয়, তাহলে শুধু কোটি টাকার যন্ত্রপাতিই নয়, ধ্বংস হয়ে যাবে এ অঞ্চলের ঐতিহ্য, শ্রমিকের স্বপ্ন আর কৃষকের জীবিকা। দিনাজপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখে এখন প্রশ্ন একটাই, সরকারের অবহেলায় কি হারিয়ে যাবে সেতাবগঞ্জ চিনিকল নামের এক ঐতিহাসিক শিল্প। অবহেলা ও যত্নে জর্জরিত এই চিনিকল।

Manual7 Ad Code